আজ তিনি বিস্মৃতপ্রায়!
এ লজ্জা লুকোই কোথায়?
সুধীন্দ্রনাথ। সুধীন্দ্রনাথ রাহা। এক সময়ের কিশোরবেলার বাঙালিকে যিনি মস্ত মস্ত সব সাগর উপহার দিয়েছেন।
আসছি তাঁর কথায়।
তার আগে ব্যক্তিগত ভাবেই নয় একটু তাঁর জমি-জিরেতটা দেখিয়ে নিই।
তখন ক্লাস টু কিংবা থ্রি।
জন্মদিনে উপহার পেয়েছিলাম, একসঙ্গে তিনটি বই। রবিনসন ক্রুশো, আঙ্কেল টমস কেবিন, আর জার্নি টু দা সেন্টার অফ আর্থ।
রঙিন হার্ড-কভারে বাঁধাই করা।
দেব সাহিত্য কুটির, আদিত্য প্রকাশনালয়ের অনুবাদ সিরিজ।
সেই শুরু বিশ্ব সাহিত্যের দরজায় কড়া নাড়া।
এই ভাবেই পড়ে ফেলেছিলাম লা মিসারেবল, অলিভার ট্যুইস্ট, ফ্রাঙ্কেনস্টাইন, থ্রি মাস্কেটিয়ার্সের অনুবাদ।
সময়টা ছিল সাতের দশক।
![](https://blogger.googleusercontent.com/img/b/R29vZ2xl/AVvXsEjMVH5ce8jXWAFXXkCXwxZIJuUOTu2Rg9yZoiVRpRkjhn439rP4z2kZcu_a4o34d773LitDdKvT0m7t970TuRcoEkv2hyphenhyphenQ1FVy3wbLj9VyK7g62Z42wzeucxuhjwBQyg8ag8EJloxDW9Ws/w452-h340/kakali+1.jpg) |
সেই সব বইগুলি.... |
তখনও ইংলিশ মিডিয়াম স্কুলের রমরমা শুরু হয়নি। মধ্যবিত্ত বাঙালি বাড়ির ছেলেমেয়ে বাড়ির কাছাকাছি বাংলা মাধ্যম স্কুলে দিব্য পড়াশোনা করতাম।
আর এই আমরা যারা বাংলা মাধ্যমে পড়াশোনা করছিলাম তখন, আমাদের কাছে এই অনুবাদ সিরিজগুলি ছিল যেন সোনার খনি। কোনও বইয়ের দাম আড়াই টাকা, কোনওটা তিন টাকা পঁচাত্তর আবার কোনটা পাঁচ টাকা।
সত্যি কথা বলতে কী, জুল ভার্ন, ড্যানিয়েল দেফো, চার্লস ডিকেন্স, আলেক্সানদার দ্যুমা–কে চিনেছি আমরা এই বইগুলির হাত ধরে। মূল সাহিত্য পড়ার সৌভাগ্য বা সুযোগ তো অনেক পরে হয়েছে।
আর যাঁদের লেখার মধ্য দিয়ে বিশ্ব সাহিত্যের সঙ্গে পরিচিত হয়েছি আমি বা আমার মতো অসংখ্য ছোট ছোট ছেলে মেয়ে, তাঁদের মধ্যে অন্যতম উল্লেখযোগ্য নাম সুধীন্দ্র নাথ রাহা। তাঁর প্রাঞ্জল লেখনীর মধ্য দিয়ে তিনি ছোটদের নিয়ে যেতে পেরেছিলেন মণিমুক্তোখচিত এক অন্য জগতে।
সুধীন্দ্রনাথ রাহা। জন্ম ১৮৯৬। খুলনার নলধা গ্রামে। পিতা যদুনাথ রাহা, মাতা মৃন্ময়ী দেবী।
কর্ম জীবনের সূত্রপাত শিলিগুড়ি বয়েজ হাই স্কুলে প্রধান শিক্ষক হিসাবে ১৯৩৮ সালে। তিনি ছিলেন একাধারে নাট্যকার, অনুবাদক ও লেখক।
প্রথম জীবনের 'বাংলার বোমা' নামে একটি ডিটেক্টিভ নাটক রচনা করেছিলেন, যা প্রথম অভিনীত হয়েছিল স্টার থিয়েটারে। ১৯৩৮ সালে।
যদিও পরবর্তী কালে তিনি অনুবাদ সাহিত্য, শিশু ও কিশোর সাহিত্য রচনার দিকেই অধিক মনোনিবেশ করেছিলেন।
'সব্যসাচী' ছদ্মনামে দীর্ঘদিন শুকতারা-য় অনুবাদ করেছেন এডগার রাইজ বারোজের টারজানের কাহিনি। ‘শ্রী বৈজ্ঞানিক’ ছদ্মনামে অনুবাদ করেছেন কল্প বিজ্ঞান নির্ভর বিদেশি ছোট গল্প।
আর ছিল তাঁর রচিত গা ছমছম করা ভৌতিক গল্প।
তার মধ্যে কিছু ছিল কিছু মৌলিক রচনা, কিছু অনুবাদ। ষাট সত্তর সাল জুড়ে শুকতারা-য় তিনি নিয়মিত লিখে গিয়েছেন এমনই অনেক মনোগ্রাহী গল্প, অনুবাদ যার পাঠক মূলতঃ শিশু, কিশোর।
![](https://blogger.googleusercontent.com/img/b/R29vZ2xl/AVvXsEhhD3PtiAJeMoKkQJjQxtUMQuQ2YVt8to4e3Md1ZZqvuB9nVTZ1rmFaSAWsGhyphenhyphenMD4Q7gKg94ebdgnGZ1r5J8E96aixdTACBqxjWXoBXJqPRSL9-ZpwSPNKHKBnpM1GEnUgHABjFFHMfJ0U/w297-h340/kakali+2.jpg) |
সুধীন্দ্রনাথ রাহা |
অনুবাদ দু’ভাবে হয়। আক্ষরিক অনুবাদ আর ভাবানুবাদ।
পরবর্তীকালে মূল গ্রন্থ পড়ার সময় অনেক বার মনে হয়েছে, কলমে কতটা মুন্সিয়ানা থাকলে মূল ভাবটি অক্ষুন্ন রেখে ছোটদের বোঝার মতো করে, ভাল লাগবার মতো করে এই অনুবাদগুলি করা সম্ভবপর হয়!
আমাদের ছোটবেলা, কিশোরবেলা সমৃদ্ধ করতে, বর্ণময় করতে সুধীন্দ্র নাথ রাহা, অদ্রীশ বর্ধন এঁদের অবদান যে বলে বোঝানো যায় না।
নানা কারণে অদ্রীশ বর্ধন হয়তো’বা তেমন অচেনা-অজানা নন বাঙালির কাছে। কিন্তু সুধীন্দ্রনাথ?
ক’জন বাঙালি মনে রেখেছে তাঁকে?
সুধীন্দ্র নাথ রাহা - অদ্রীশ বর্ধন ছাড়াও আর ছিলেন অনেকে।
কান্তি. পি. দত্ত, সুবোধ চক্রবর্তী, ইন্দুভূষণ দাস।
এঁদের প্রত্যেকের কাছে আমরা ঋণী, কারণ এঁরা আমাদের পরিচিত করেছেন বিশ্ব সাহিত্যের সঙ্গে।
বাংলার বোমা নাটকটিতে শ্রী রাহা তুলে ধরেছিলেন এমন কিছু দুষ্কৃতকারীকে যারা বিপ্লবীদের ভেক ধরে অর্থ উপার্জন ও প্রতারণা চালিয়ে যাচ্ছিল।
তাঁদের মুখোশ খুলে দেওয়ার চেষ্টা করেছিলেন এই নাটকের মধ্য দিয়ে। আবার ‘মারাঠা মোগল’ নাটকে ছিল মারাঠা আন্দোলনের আড়ালে দেশ মাতৃকার বন্দনা। যদিও ১৯৪২-এর ভারত ছাড়ো আন্দোলন এবং ১৯৪৩-৪৪-এর মন্বন্তর বাংলা রঙ্গমঞ্চ-কে অনেকাংশে স্তব্ধ করে দিয়েছিল। ১৯৪৯-এ ‘বিক্রমাদিত্য’ নাটক রচনার পর তিনি পাকাপাকি ভাবে নাট্য জগৎ থেকে অবসর নেন এবং কিশোর সাহিত্য রচনায় নিজেকে নিয়োজিত করেন।
শোধ করা যায় না তাঁদের ঋণ।
অত্যন্ত লজ্জার সঙ্গে স্বীকার করতেই হয় সেদিনের অসংখ্য পাঠকের স্বীকৃতির স্থান থেকে অনেকটাই বিস্মৃতির আড়ালে চলে গিয়েছেন এঁদের অনেকেই।
যেমন সুধীন্দ্রনাথ।
ঊননব্বই বছর বয়সে সুধীন্দ্র নাথ রাহা ব্রঙ্কাইটিসে আক্রান্ত হন ও জীবনের শেষ সাতদিন কাটান নার্সিংহোমে। সেখানেই তাঁর মৃত্যু হয়। মৃত্যুর তিনমাস আগে তিনি প্রাতিষ্ঠানিক স্বীকৃতি হিসাবে পান ‘কালিদাস পুরস্কার ‘। যদিও শারীরিক কারণে তিনি স্বহস্তে তা গ্রহণ করতে পারেননি।
যে মানুষটার হাত ধরে একদিন রবিনসন ক্রুশোর সঙ্গে নির্জন দ্বীপে পা রেখেছিলাম আমাদের প্রজন্মের কিংবা তার কিছু আগে পরের কিশোর কিশোরীরা, তিনিই হয়তো অজানা রয়ে গিয়েছেন এখনকার প্রজন্মের পাঠক পাঠিকাদের কাছে।
গ্রাফিক্সঃ জয়দীপ সেন
আমাদের ব্লগে প্রকাশিত আরও লেখা