Saturday, April 3, 2021

বাংলার ঘরে ঘরে বিদেশি সাহিত্য চিনিয়েছিলেন সুধীন্দ্রনাথ




বাংলার ঘরে ঘরে বিদেশি সাহিত্য চিনিয়েছিলেন সুধীন্দ্রনাথ

কাকলি মিত্র বাগচী
আইনজীবী
আজ তিনি বিস্মৃতপ্রায়! এ লজ্জা লুকোই কোথায়? সুধীন্দ্রনাথ। সুধীন্দ্রনাথ রাহা। এক সময়ের কিশোরবেলার বাঙালিকে যিনি মস্ত মস্ত সব সাগর উপহার দিয়েছেন। আসছি তাঁর কথায়। তার আগে ব্যক্তিগত ভাবেই নয় একটু তাঁর জমি-জিরেতটা দেখিয়ে নিই। তখন ক্লাস টু কিংবা থ্রি। জন্মদিনে উপহার পেয়েছিলাম, একসঙ্গে তিনটি বই। রবিনসন ক্রুশো, আঙ্কেল টমস কেবিন, আর জার্নি টু দা সেন্টার অফ আর্থ। রঙিন হার্ড-কভারে বাঁধাই করা। দেব সাহিত্য কুটির, আদিত্য প্রকাশনালয়ের অনুবাদ সিরিজ। সেই শুরু বিশ্ব সাহিত্যের দরজায় কড়া নাড়া। এই ভাবেই পড়ে ফেলেছিলাম লা মিসারেবল, অলিভার ট্যুইস্ট, ফ্রাঙ্কেনস্টাইন, থ্রি মাস্কেটিয়ার্সের অনুবাদ। সময়টা ছিল সাতের দশক।
সেই সব বইগুলি....
তখনও ইংলিশ মিডিয়াম স্কুলের রমরমা শুরু হয়নি। মধ্যবিত্ত বাঙালি বাড়ির ছেলেমেয়ে বাড়ির কাছাকাছি বাংলা মাধ্যম স্কুলে দিব্য পড়াশোনা করতাম। আর এই আমরা যারা বাংলা মাধ্যমে পড়াশোনা করছিলাম তখন, আমাদের কাছে এই অনুবাদ সিরিজগুলি ছিল যেন সোনার খনি। কোনও বইয়ের দাম আড়াই টাকা, কোনওটা তিন টাকা পঁচাত্তর আবার কোনটা পাঁচ টাকা। সত্যি কথা বলতে কী, জুল ভার্ন, ড্যানিয়েল দেফো, চার্লস ডিকেন্স, আলেক্সানদার দ্যুমা–কে চিনেছি আমরা এই বইগুলির হাত ধরে। মূল সাহিত্য পড়ার সৌভাগ্য বা সুযোগ তো অনেক পরে হয়েছে। আর যাঁদের লেখার মধ্য দিয়ে বিশ্ব সাহিত্যের সঙ্গে পরিচিত হয়েছি আমি বা আমার মতো অসংখ্য ছোট ছোট ছেলে মেয়ে, তাঁদের মধ্যে অন্যতম উল্লেখযোগ্য নাম সুধীন্দ্র নাথ রাহা। তাঁর প্রাঞ্জল লেখনীর মধ্য দিয়ে তিনি ছোটদের নিয়ে যেতে পেরেছিলেন মণিমুক্তোখচিত এক অন্য জগতে। সুধীন্দ্রনাথ রাহা। জন্ম ১৮৯৬। খুলনার নলধা গ্রামে। পিতা যদুনাথ রাহা, মাতা মৃন্ময়ী দেবী। কর্ম জীবনের সূত্রপাত শিলিগুড়ি বয়েজ হাই স্কুলে প্রধান শিক্ষক হিসাবে ১৯৩৮ সালে। তিনি ছিলেন একাধারে নাট্যকার, অনুবাদক ও লেখক। প্রথম জীবনের 'বাংলার বোমা' নামে একটি ডিটেক্টিভ নাটক রচনা করেছিলেন, যা প্রথম অভিনীত হয়েছিল স্টার থিয়েটারে। ১৯৩৮ সালে। যদিও পরবর্তী কালে তিনি অনুবাদ সাহিত্য, শিশু ও কিশোর সাহিত্য রচনার দিকেই অধিক মনোনিবেশ করেছিলেন। 'সব্যসাচী' ছদ্মনামে দীর্ঘদিন শুকতারা-য় অনুবাদ করেছেন এডগার রাইজ বারোজের টারজানের কাহিনি। ‘শ্রী বৈজ্ঞানিক’ ছদ্মনামে অনুবাদ করেছেন কল্প বিজ্ঞান নির্ভর বিদেশি ছোট গল্প। আর ছিল তাঁর রচিত গা ছমছম করা ভৌতিক গল্প। তার মধ্যে কিছু ছিল কিছু মৌলিক রচনা, কিছু অনুবাদ। ষাট সত্তর সাল জুড়ে শুকতারা-য় তিনি নিয়মিত লিখে গিয়েছেন এমনই অনেক মনোগ্রাহী গল্প, অনুবাদ যার পাঠক মূলতঃ শিশু, কিশোর।
সুধীন্দ্রনাথ রাহা
অনুবাদ দু’ভাবে হয়। আক্ষরিক অনুবাদ আর ভাবানুবাদ। পরবর্তীকালে মূল গ্রন্থ পড়ার সময় অনেক বার মনে হয়েছে, কলমে কতটা মুন্সিয়ানা থাকলে মূল ভাবটি অক্ষুন্ন রেখে ছোটদের বোঝার মতো করে, ভাল লাগবার মতো করে এই অনুবাদগুলি করা সম্ভবপর হয়! আমাদের ছোটবেলা, কিশোরবেলা সমৃদ্ধ করতে, বর্ণময় করতে সুধীন্দ্র নাথ রাহা, অদ্রীশ বর্ধন এঁদের অবদান যে বলে বোঝানো যায় না। নানা কারণে অদ্রীশ বর্ধন হয়তো’বা তেমন অচেনা-অজানা নন বাঙালির কাছে। কিন্তু সুধীন্দ্রনাথ? ক’জন বাঙালি মনে রেখেছে তাঁকে? সুধীন্দ্র নাথ রাহা - অদ্রীশ বর্ধন ছাড়াও আর ছিলেন অনেকে। কান্তি. পি. দত্ত, সুবোধ চক্রবর্তী, ইন্দুভূষণ দাস। এঁদের প্রত্যেকের কাছে আমরা ঋণী, কারণ এঁরা আমাদের পরিচিত করেছেন বিশ্ব সাহিত্যের সঙ্গে। বাংলার বোমা নাটকটিতে শ্রী রাহা তুলে ধরেছিলেন এমন কিছু দুষ্কৃতকারীকে যারা বিপ্লবীদের ভেক ধরে অর্থ উপার্জন ও প্রতারণা চালিয়ে যাচ্ছিল। তাঁদের মুখোশ খুলে দেওয়ার চেষ্টা করেছিলেন এই নাটকের মধ্য দিয়ে। আবার ‘মারাঠা মোগল’ নাটকে ছিল মারাঠা আন্দোলনের আড়ালে দেশ মাতৃকার বন্দনা। যদিও ১৯৪২-এর ভারত ছাড়ো আন্দোলন এবং ১৯৪৩-৪৪-এর মন্বন্তর বাংলা রঙ্গমঞ্চ-কে অনেকাংশে স্তব্ধ করে দিয়েছিল। ১৯৪৯-এ ‘বিক্রমাদিত্য’ নাটক রচনার পর তিনি পাকাপাকি ভাবে নাট্য জগৎ থেকে অবসর নেন এবং কিশোর সাহিত্য রচনায় নিজেকে নিয়োজিত করেন। শোধ করা যায় না তাঁদের ঋণ। অত্যন্ত লজ্জার সঙ্গে স্বীকার করতেই হয় সেদিনের অসংখ্য পাঠকের স্বীকৃতির স্থান থেকে অনেকটাই বিস্মৃতির আড়ালে চলে গিয়েছেন এঁদের অনেকেই। যেমন সুধীন্দ্রনাথ। ঊননব্বই বছর বয়সে সুধীন্দ্র নাথ রাহা ব্রঙ্কাইটিসে আক্রান্ত হন ও জীবনের শেষ সাতদিন কাটান নার্সিংহোমে। সেখানেই তাঁর মৃত্যু হয়। মৃত্যুর তিনমাস আগে তিনি প্রাতিষ্ঠানিক স্বীকৃতি হিসাবে পান ‘কালিদাস পুরস্কার ‘। যদিও শারীরিক কারণে তিনি স্বহস্তে তা গ্রহণ করতে পারেননি। যে মানুষটার হাত ধরে একদিন রবিনসন ক্রুশোর সঙ্গে নির্জন দ্বীপে পা রেখেছিলাম আমাদের প্রজন্মের কিংবা তার কিছু আগে পরের কিশোর কিশোরীরা, তিনিই হয়তো অজানা রয়ে গিয়েছেন এখনকার প্রজন্মের পাঠক পাঠিকাদের কাছে। গ্রাফিক্সঃ জয়দীপ সেন

আমাদের ব্লগে প্রকাশিত আরও লেখা

 

Wednesday, March 31, 2021

দাদা হাবিবকে ধরিয়ে দিলেন ভাই আকবর কেন কীভাবে পর্ব ৫

১৯৭৫ নিয়ে তাঁর দুঃখবোধ আজও বহাল


দাদা হাবিবকে ধরিয়ে দিলেন ভাই আকবর কেন কীভাবে পর্ব ৫

সুপ্রিয় মুখোপাধ্যায়
ক্রীড়া সাংবাদিক
আবার পরের দিন। সকাল। জানকীনগরের বাড়ি। সোফায় বসা বড়ে মিঞা। দূর থেকে তখন আজানের স্বর ভেসে আসছে। আল্লা....আ...আ... মিঞার চোখ সিলিঙের দিকে। থমথমে মুখে। গায়ে দুধসাদা পাঞ্জাবি। কালো চশমার আড়ালটা এদিন নেই। ঈষৎ ফ্যাকাশে লাগছে যেন চার দশক আগের ময়দানের নবাবকে। একটু পৱেই আমরা ঢুকে পড়লাম মধ্য সত্তরের এক বিতর্কিত অধ্যায়-এ। তার শুরুতেই তাচ্ছিল্যের হাসি। তারপরই যেন শব্দ হারিয়ে ফেললেন। অস্ফূটস্বরে বললেন, ‘‘কসুর মেরা ভি থা। লেকিন উও লোগ সব বেকার কর দিয়া!’’ আসলে ১৯৭৫-এ লাল-হলুদ জনতাকে ভাসিয়ে দিয়ে ইস্টবেঙ্গল ছেড়ে মহমেডান স্পোর্টিংয়ে চলে যান হাবিব। একা নয়। সঙ্গে আকবর, লতিফুদ্দিন, মহম্মদ নাজির। টানা পাঁচবার কলকাতা লিগ জেতার পুরনো গৌরব তখনও মহমেডানের দখলে। ময়দানে রটেছিল 'কট্টর মৌলবাদী' হাবিব চাননি মহমেডানের সেই রেকর্ড ভেঙে যাক সেবছর ইস্টবেঙ্গলের হাতে। তাই সেবার লাল-হলুদ জার্সি ত্যাগ! এমনকী হাবিবের মহাগুরু, তখনকার ইস্টবেঙ্গল কোচ পিকে-ও নাকি ঘরোয়া আড্ডায় সেই সম্ভাবনার কথা উড়িয়ে দেননি! অথচ তার আগে পর্যন্ত ১৯৭০-৭৪, পাঁচ বছর হাবিব ইস্টবেঙ্গলে খেলার সময় টানা ১৯৩২ দিন মোহনবাগানের কাছে হারের মুখ দেখেনি লাল-হলুদ। তা সত্ত্বেও 'মিস্টার ফাইটার অফ ইন্ডিয়ান ফুটবল'-এর বিরুদ্ধে ১৯৭৫-এ ওই অভিযোগ!
৭০ দশক। কোচ প্রদীপ বন্দ্যোপাধ্যায়। লাল-হলুদ ব্রিগেডকে নির্দেশ দিচ্ছেন সাইড লাইন থেকে
মহায়দরাবাদের বাড়িতে তাঁর সামনেই কথাটা তোলার আগে ভাবছিলাম এবার নির্ঘাত ফেটে পড়বেন। টেপরেকর্ডার বন্ধ-টন্ধ করিয়ে সটান বলে দেবেন, ইন্টারভিউ এখানেই শেষ। কিন্তু ২০১৫-র হাবিব কী করেছিলেন? হো হো করে হাসতে লাগলেন! সাতষট্টির (এই মুহূর্তে বাহাত্তর চলছে মিঞার) প্রৌঢ় শরীরটা সোফায় প্রায় গড়িয়ে পড়ার জোগাড়। ‘‘আরে দাঁড়ান, দাঁড়ান! এটা তো জানতাম না? হাবিব ফান্ডামেন্টালিস্ট? হাবিব?’’ আবার অট্টহাসি! খানিকটা হতভম্ব হয়ে তাকিয়ে আছি! এক পলক দেখে বড়ে মিঞা ফের বললেন, ‘‘আমি যদি সত্যিই এতটা গোঁড়া মুসলিম হতাম তা’হলে তো সবচেয়ে বেশি মহমেডানে খেলতাম! অথচ সবচেয়ে কম বছর খেলেছি ওই ক্লাবে। ইস্টবেঙ্গলে খেলেছি আট বছর। মোহনবাগানে সাত বছর।’’ থামলেন একটু। তারপরেই প্রচন্ড সিরিয়াস ঢঙে টানা বলে চললেন— ‘‘পঁচাত্তরে ইস্টবেঙ্গল ছাড়ার দুঃখ আজ ৪০ বছর পরেও আমি পাই। ওই ভুলের জন্য নিজেকে কোনওদিনও ক্ষমা করতে পারব না আমি। ইস্, আগের পাঁচ বছর থাকলাম, আর ইস্টবেঙ্গলের রেকর্ডের বছরেই থাকলাম না! আমার ভুলের জন্য আকবরও একটা বিরাট গৌরবের সঙ্গে নিজেকে জড়িয়ে রাখতে পারেনি। যার জন্য আমার ভাইয়ার কাছেও আমি আজীবন লজ্জায় থাকব। আসলে কী জানেন? ইস্টবেঙ্গলে তখন সেক্রেটারি ডাক্তারদা (ডাঃ নৃপেন দাস)। দারুণ মানুষ। দারুণভাবে ক্লাব চালাচ্ছিলেন। টিম টানা ছ'বার লিগ চ্যাম্পিয়ন হয়ে নতুন রেকর্ড করার পথে। সেটা হলে ক্লাবে ডাক্তারদার হাত আরও শক্ত হবে। কিন্তু সেটা ইস্টবেঙ্গলেরই একটা গোষ্ঠীর কর্তারা সেবার চাইছিলেন না। এরাই ঘুরিয়ে রটিয়ে দিয়েছিলেন, মুসলিম হাবিব-আকবর নাকি চায় না মহমেডানের রেকর্ড ভেঙে যাক। এবার ওরা দলে থাকলে সাবোটাজ করবে। তাই ওদের দলে রেখো না। কোচও নাকি সেরকম ভাবছে। আমিও ওই রটনায় প্রচন্ড রেগেমেগে একদিন প্রদীপদার সঙ্গে ঝগড়া করে বসেছিলাম। তাতে সেসময় প্রদীপদাও আমার ওপর খানিকটা রেগে ছিলেন। এখন শুধু ভাবি, ইস্! আমি যদি একবার নিজের থেকে ডাক্তারদার সঙ্গে এ নিয়ে সরাসরি কথা বলতাম, তা’হলে জীবনের এত বড় ভুলটা করে বসতাম না!’’
ডা. নৃপেন দাস। প্রাক্তন ইস্টবেঙ্গল সাধারণ সচিব
আফসোস। আফসোস। মনে এখনও তাজা গভীর ক্ষত। ভীষণ মায়া লাগছিল, এমন সময় ওঁকে দেখতে। বয়স বাড়লে মানুষ তো খানিক ‘শিশু’ও হয়ে পড়ে! কিছু স্মৃতি টাটকা হলেও নিজের বয়সটাও ঠিকমতো জানান দিতে পারে না। তিনদিনে তিনরকম বললেন! একবার বললেন, ‘‘একষট্টি চলছে।’’ আর একদিন, ‘‘আমার নাইনটিন ফর্টিনাইনে জন্ম।’’ তা’হলে হয় ছেষট্টি বছর। আমি হিসেব করছিলাম হাবিব 'অর্জুন' হয়েছিলেন গুরদেব সিংহেরও দু'বছর পর। বেশ মনে পড়ে। ফেডারেশনের তুঘলকি কারবারের সে ছিল ভয়ঙ্কর নিদর্শন। সেই ঘটনা আপমর ফুটবল-প্রেমী ভোলেনি। অথচ দেশের রাষ্ট্রপতির হাত থেকে পুরস্কার নেওয়ার সাল-তারিখ আজ বেমালুম ভুলে মেরেছেন হাবিব? কী বলব একে? বার্ধক্য? বললাম, ‘‘অর্জুনটা কোথায়? এ বাড়িতে? না আগের বাড়িতে?’’ হাঁ করে তাকালেন। তারপর বললেন, ‘‘কে জানে? বিবি বোধহয় জানে। শেষবার তো ওটা পুরনো বাড়ির আলমারিতেই দেখেছিলাম। যতদূর মনে হচ্ছে!’’ আমি সালটা বিলক্ষণ মনে করতে পারি। ১৯৮০। গুরদেব ১৯৭৮। অথচ সময়ের কথা উঠতে অবলীলায় বড়ে মিঞা বললেন, ‘‘আমার শাদি ’৭৩-এ। আর তারপরের বছরই অর্জুন।’’ এরপরে এই মানুষের বাকি সব ট্রফি, মেমেন্টোর খোঁজ নেওয়ার আর মানে হয়? (চলবে) ছবিঃ উৎপল সরকার ও সংগৃহীত ৪র্থ পর্ব পড়তে এই লিঙ্কে ক্লিক করুন
  ৬ষ্ঠ পর্ব পড়তে এই লিঙ্কে ক্লিক করুন

আমাদের ব্লগে প্রকাশিত আরও লেখা

 

Friday, March 26, 2021

দাদা হাবিবকে ধরিয়ে দিলেন ভাই আকবর কেন কীভাবে পর্ব ৪

মিঞা এবং বিবি


দাদা হাবিবকে ধরিয়ে দিলেন ভাই আকবর কেন কীভাবে পর্ব ৪

সুপ্রিয় মুখোপাধ্যায়
ক্রীড়া সাংবাদিক
ঔজ্জ্বল্য যেমন আছে স্মৃতিতে, তেমন আছে গভীর দুঃখবোধের নিকষ আঁধার! এই হল আজকের মহম্মদ হাবিব। তরতরিয়ে কথা বলেন মাঝে মাঝে। আবার বেশ বিরক্তও হয়ে যান সময়ে সময়ে। তিনদিনে যখনই বাড়ির বাইরে বেরিয়েছি মুহুর্মুহু তাগাদা দিয়েছেন, ‘‘বাড়ি চলুন, বাড়ি চলুন। অনেক তো ছবি হল!’’ ব্রেকফাস্ট? তাতেও ‘মুসকিল আচে’! তারপর হয়তো’বা ভাই আকবর সঙ্গে আছে ভেবে বলেছেন, ‘‘কী আকবর ভাইয়া? তোর ফেভারিট মশালা দোসা হতে পারে, কী বলিস?’’ পরে জেনেছিলাম, বড়ে মিঞার ফেভারিট ডিশ— মটন বিরিয়ানি, মটন মশালা আর চাপাটি। তিনটেই খোদ নিজামের শহরেও অত সকালের মেনুতে পড়ে না। তাই-ই হয়তো ভাইকে ওই 'পাস'টা বাড়ানো তাঁর প্রিয় দাদার। এখানে আরও একটা ছোট্ট গল্প বলতে লোভ হচ্ছে। যার সঙ্গে জড়িয়ে অভিমানী হাবিব আর তাঁর বিবিও! চার দশক আগে ময়দানের সুপারস্টার ফুটবলার হাবিব তাঁর বিবির জন্য পেলে-ম্যাচের একটা টিকিট ধীরেন দে-র কাছ থেকে জোগাড় করতে পারেননি! সে অভিমান আজও ভোলেননি।
চালক এখন ভাই
ময়দানে বহু ইস্টবেঙ্গল-মোহনবাগান ম্যাচ দেখতে গিয়েছেন হাবিবের স্ত্রী রাইসা বেগম। সত্তরের দশকে। থেকেছেন আমিনিয়া হোটেলে। মজার ব্যাপার হল, কলকাতায় তাঁর বিবির প্রিয় দু’টো খাবারের একটা অন্তত প্রায় হাবিবি-ঘরানার। নিজামের হোয়াইট চিকেন রেজালা! আর তার সঙ্গে তিওয়ারির কাজুবরফি। মিঞা অনেক খাইয়েছেন তাঁকে। এ সব সুখস্মৃতি। তার সঙ্গেও কী ভাবে দুঃখবোধের স্বর লুকিয়ে থাকে মানুষের জীবনে! পেলে ম্যাচের আড্ডার শুরু গোলকুন্ডা ফোর্ট-এ। একটু বাদে তার লাগোয়া এবড়োখেবড়ো ভরা রাস্তার উপর মামুলি রেস্তোরাঁ। তা’ও পেরিয়ে কিছুক্ষণের মধ্যে হাবিবের বাড়ির ছোট্ট ড্রইংরুমে। তিনতলা কিংবা একতলা, দু’টো ফ্ল্যাটেই আড়ম্বরের চিহ্নমাত্র নেই। টিপিক্যাল মুসলিম বাড়ির অন্দরমহল। বাইরের বসার ঘর আর ভেতরের ঘরের মাঝবরাবর ঝলমলে নেটের পর্দাটুকুও বহাল। বাইরের ঘরে বসে আছি। সামনে বড়ে মিঞা। বিবি রাইসাকে ডেকে পাঠালেন খানিক বাদেই। সেই প্রথম সত্যিকারের খোসমেজাজে সম্রাট! কয়েক মিনিটের ভেতর ঈষৎ স্থূলকায় চেহারার হাবিব-পত্নী বাইরের ঘরে আসতেই হাবিব বলে উঠলেন, ‘‘এদের বলো পেলে ম্যাচের দিন আমি ঠিক কীরকম অবস্থায় ছিলাম!’’ রাইসার পিছন-পিছন লাইন দিয়ে ঘরে ঢুকে পড়েছে তাঁদের চার নাতনি। আরিফা, আতিফা, জেবা, সানা। ফুটফুটে বাচ্চাগুলো পাঁচ থেকে পনেরোর মধ্যে। প্রথম দু’জন হাবিবের মেয়ে হারিসার কন্যা। পরের দু’জন হাবিবের ছেলে মহম্মদ হাসিবের তনয়া। পুত্রবধূ সামরিনের সঙ্গে যারা ওই সময়ে জেড্ডা থেকে রমজান মাসটা তাদের দাদুর বাড়িতে কাটাতে এসেছে।
ফুটবল সম্রাটের সামনে লড়াকু নবাব
হাবিবের একমাত্র ছেলে এম.টেক। অস্ট্রেলিয়ায় দীর্ঘদিন উচ্চশিক্ষার খাতিরে ডনের দেশের নাগরিকত্ব রয়েছে। আবার জেড্ডায় নামী কম্পিউটার সংস্থায় উঁচু পদেও রয়েছেন তিনি। কোনওকালেই ছেলেকে ফুটবলার করতে চাননি হাবিব। প্রশ্ন ফেলতেই রাইসা বললেন— ‘‘আসলে আমাদের ওই একটাই ছেলে তো। কোনও ঝুঁকি নিতে চাইনি।’’ এরপর এক নিঃশ্বাসে বলে চললেন, ‘‘তাছাড়া আমার বাপের বাড়ির দিকে সবার প্রচুর পড়াশোনা। খুব শিক্ষিত। ওদের দিক থেকে একটা চাপ ছিল ছেলেকে অনেক দূর পড়াশোনা করানোর ব্যাপারে। তাছাড়া সবচেয়ে বড় কথা, বাবার মতো বড় ফুটবলার হওয়ার প্রতিভাও ছিল না হাসিবের।’’ তারপরই পে‌লে-ম্যাচের কথায় বিবি। ‘‘সেদিন সকাল থেকে ও ভীষণ তেতে ছিল। এতটাই যে তখনকার দিনেও কলকাতা-হায়দরাবাদ ট্রাঙ্ককল করে আমার সঙ্গে ঝাড়া পনেরো মিনিট কথা বলেছিল। কত টাকা বিল উঠছে সেই চিন্তাও ওই মুহূর্তে ছিল না ওর। একবার তো ফোনেই চিৎকার করে উঠেছিল, আরে ছোড়িয়ে তো? পেলে ভি ফুটবলার হ্যায়, ম্যায় ভি ফুটবলার হুঁ। হাম দোনো একই খেল খেলতা হ্যায়। আউর উসকা নাম ফুটবল। পেলে কো ভি আজ ছোড়েঙ্গে নেহি!’’ ভাবা যায়! পেলের বিরুদ্ধে নামার আগে গোটা পৃথিবীতে হাবিব ছাড়া এরকম কথা কেউ কোনও দিন বলেছে কিনা সন্দেহ! মিঞা বললেন— ‘‘আসলে মাঠে নামলে কাউকে ভয় পেতাম না। সাপোর্টররা তাই বাঘের বাচ্চা বলে আদর করে ডাকত।’’ হাসি খেলে গেল মিঞার চোখে! ‘‘ম্যাচের পর গ্র্যান্ড হোটেলে ডিনার পার্টি। ধীরেন দে আর প্রদীপদার সামনে পেলে আমাকে বুকে জড়িয়ে ধরে বলেছিলেন, ইউ উড বি ইন্ডিয়ান পেলে,’’ একটানা কথাগুলো বলার সময় বিবি রাইসার সামনে তখন গদগদচিত্ত এতক্ষণের ব্যাজারমুখো মহম্মদ হাবিব-ও! (চলবে) ছবিঃ উৎপল সরকার ও সংগৃহীত ৩য় পর্ব পড়তে এই লিঙ্কে ক্লিক করুন 
  ৫ম পর্ব পড়তে এই লিঙ্কে ক্লিক করুন

আমাদের ব্লগে প্রকাশিত আরও লেখা